তিন বিসিএসে পাস করেও ভেরিফিকেশনে আটকা, অন্য চাকরি খুঁজতে বলেছিল পুলিশ

তিন বিসিএসে পাস করেও ভেরিফিকেশনে আটকা, অন্য চাকরি খুঁজতে বলেছিল পুলিশ

পরপর তিনটি বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মো. সাইদুল ইসলাম। কিন্তু পুলিশের নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে স্বপ্নের চাকরি পেয়েও একটিতেও যোগ দিতে পারেননি। তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা সাইদুলকে বলেছিলেন, সাইদুলের নামে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু সাইদুল ইসলামের বাবা ও ভাই বিরোধীদলীয় রাজনীতি করায় তাঁর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। সাইদুলকে সরকারি চাকরির আশা বাদ দিয়ে অন্য কোনো বেসরকারি চাকরি খুঁজতে বলেছিলেন ওই পুলিশ কর্মকর্তারা।

৩৮তম বিসিএস, ৩৯তম বিশেষ বিসিএস ও ৪০তম বিসিএসে পাস করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) থেকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পেয়েছিলেন মো. সাইদুল ইসলাম। ২০১৯ সালে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগের জন্য সুপারিশ পান মো. সাইদুল ইসলাম। এটি যেহেতু বিশেষ বিসিএস ছিল, তাই বাদ পড়ার কথা চিন্তাও করেননি তিনি। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গেজেটে নিজের নাম না দেখে ভেঙে পড়েন মো. সাইদুল ইসলাম।

২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পর পুলিশের নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে গেজেট থেকে বাদ পড়া ২৫৯ প্রার্থীকে নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১ সেপ্টেম্বর সহকারী সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করেছেন সাইদুল ইসলাম।

সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার চার বছর শুধু বিসিএসের জন্য পড়েছিলাম। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর জন্য বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া অনেক কঠিন। এত কষ্ট করে বিসিএস পাস করার পরও গেজেটে নিজের নাম না দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর আমার উপজেলার পীরগাছা থানায় যোগাযোগ করি। থানা থেকে বলা হয়, আমার নামে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আমার বাবা ও ভাই বিএনপির রাজনীতি করায় আমার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।’

এরপর সাইদুল ইসলাম যোগাযোগ করেন রংপুর জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। তখন রংপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন বিপ্লব কুমার সরকার। মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ সুপারের কক্ষে ঢোকার পর পুলিশ সুপার বলেন, “বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপজেলার সভাপতির ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার বানানোর জন্য সরকার আমাকে এ চেয়ারে বসায়নি।” এরপর ৩৮তম বিসিএসে গেজেট থেকে বাদ পড়ার পর আবার বিপ্লব কুমারের কাছে গেলে তিনি বলেন, “আপনি অন্য বেসরকারি চাকরি বা বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেন। আপনার সরকারি চাকরি হবে না।”’

৩৯তম বিশেষ বিসিএস ও ৩৮তম বিসিএসে গেজেট থেকে বাদ পড়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় যোগাযোগ করেছিলেন সাইদুল ইসলাম। এ তিন জায়গা থেকেই বলা হয়েছিল, পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনে আপনার নামে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আপনার পরিবার ভিন্ন মতাদর্শী হওয়ায় আপনার নিয়োগের ফাইল আটকে রাখা হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ের সমাধান হবে না। যেহেতু দুটি বিসিএসে সুপারিশের পরও গেজেটভুক্ত হতে পারেননি, তাই ৪০তম বিসিএসে গেজেট থেকে বাদ পড়ার হতাশায় আর কোনো যোগাযোগ করেননি। বিসিএসে যোগ দেওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

গেজেটভুক্ত হতে সাইদুল ইসলাম হাইকোর্টে রিটও করেছিলেন। সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মতো বাদ পড়া ৩৮ জন মিলে ২০২০ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট আমাদের নিয়োগ দিতে আদেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আদেশের দুদিন পর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের পর আমাদের নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়।’

মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কষ্ট পেতাম বাবার কান্না দেখে। বাবা আক্ষেপ করে বলতেন, তিনি রাজনীতি করায় আমার বিসিএস হয়নি। তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। এটা যে কী ধরনের ট্রমা, যার পরিবারে হয়, শুধু সে বোঝে। আমার মতো আর কেউ তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অবমূল্যায়িত হোক, এটা চাই না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে একজন চাকরিপ্রার্থীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নষ্ট করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই।’

পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে জানতে রংপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পর পুলিশের নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে গেজেট থেকে বাদ পড়া ২৫৯ প্রার্থীকে গত ১৪ আগস্ট নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ও বৈষম্যের অবসান হয়। ১ সেপ্টেম্বর আমার নিজ উপজেলা পীরগাছায় সহকারী সার্জন হিসেবে যোগ দিয়েছি।’

admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *